স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) যেন এক ভয়ঙ্কর চক্রের হাতে জিম্মি। এই চক্রের মধ্যমণি শামীম আহমেদ, যিনি নিজেকে পরিচয় দেন ‘মাফিয়া শামীম’ নামে। এলজিইডির প্রত্যন্ত করিডোর থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তাদের কক্ষে এখন উচ্চারিত হয় একটিই নাম—মাফিয়া শামীম।
কে এই শামীম আহমেদ?
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সন্তান শামীম আহমেদ দীর্ঘদিন ধরেই এলজিইডিতে ঠিকাদারির আড়ালে চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলের ভয়াল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার বড় ভাই শাহজাহান আহমেদ ছিলেন এলজিইডির একজন ঠিকাদার, যিনি শুরুতে শামীমকে এই পেশায় আনেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শামীম তার ভাইকে পেছনে ফেলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
শামীমের পরিচয় বহুমাত্রিক—কখনো তিনি লন্ডন শামীম, কখনো যুবলীগ নেতা শেখ ফাহিমের খালাতো ভাই, আবার কখনোবা বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তবে সব ছাপিয়ে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন ‘মাফিয়া শামীম’ নামে।
ভয় আর ব্ল্যাকমেইলের রাজত্ব
সরবরাহকারী ও ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, এলজিইডিতে কাজ করতে হলে প্রতি মাসে শামীমকে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। কেউ চাঁদা না দিলে শুরু হয় হয়রানি, বদনাম রটানো, প্রাণনাশের হুমকি এবং ব্ল্যাকমেইল।
শামীম তার টার্গেট করা প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে যায় বিভিন্ন ক্লাবে, মদের আসর ও নারীদের মাধ্যমে তাদের ফাঁদে ফেলে ভিডিও ধারণ করেন। এরপর শুরু হয় চিরাচরিত ব্ল্যাকমেইল। সাবেক প্রকল্প পরিচালক গৌতম চন্দ্র থেকে শুরু করে এলজিইডির হিসাবরক্ষকরা পর্যন্ত বাদ যাননি শামীমের ফাঁদ থেকে।
ভুয়া বিল, প্রকল্প লুট আর কোটি কোটি টাকার মালিকানা
শামীমের বিরুদ্ধে রয়েছে ভুয়া বিল বানিয়ে এক প্রকল্পের টাকা একাধিকবার উত্তোলনের অভিযোগ। সামান্য পণ্য সরবরাহ করেও তিনি আদায় করেছেন সর্বোচ্চ দাম। সাবেক প্রধান প্রকৌশলীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে তিনি শত কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে তার নামে ও স্ত্রীর নামে রয়েছে ঢাকার আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া, উত্তরা, পূর্বাচল এবং সাভারে অসংখ্য ফ্ল্যাট, জমি ও বিলাসবহুল গাড়ি। এমনকি শ্যাওড়াপাড়ায় রয়েছে একটি মদের বারও।
নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র
শুধু অর্থ নয়, নারী নিপীড়নের অভিযোগেও রয়েছে তার ভয়ঙ্কর রেকর্ড। এলজিইডির এক নারী কর্মকর্তা (ছদ্মনাম: অবনি) অভিযোগ করেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন শামীম। পরবর্তীতে সেই নারী তার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল, যার ফলে ভেঙে যায় তার সংসার। এভাবে শামীমের হাতে শতাধিক নারী হয়েছেন নিগৃহীত।
কেনো এত শক্তিশালী শামীম?
শামীমের পেছনে রয়েছেন আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার শেখ ফাহিম, যার ছায়াতলে থেকেই এতদিন ধরেই অনায়াসে অপরাধ সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এলজিইডির প্রকৌশলীদের সাথে গড়ে তুলেছেন ভয়ানক এক ব্ল্যাকমেইল চক্র, যার মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অথচ এখনো পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি।
নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা কি তবে ব্যর্থ?
নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা যারা দেখি, তারা আজ প্রশ্ন করি—মাফিয়া শামীমের মতো দুর্বৃত্তরা যদি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তবে কি আমরা সত্যিই বদলে যাচ্ছি? না কি শুধু নাম বদলাচ্ছে, মাফিয়াদের শাসন ঠিকই চলছে?
এই শামীমদের দৌরাত্ম্য থামাতে এখনই প্রয়োজন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ। না হলে, ২০২৪ সালের বাংলাদেশেও দুর্নীতি, চাঁদাবাজি আর ব্ল্যাকমেইলের কাছে হেরে যাবে সাধারণ মানুষ।